বুধবার ৮ অক্টোবর ২০২৫ - ২০:৩৩
কীভাবে একজন সফল মা ও আদর্শ শিক্ষিকা হওয়া যায়?

একজন মা কেবল সন্তান জন্ম দেন না—তিনি এক মানবপ্রজন্ম গড়ে তোলেন। সন্তানের প্রথম বিদ্যালয় হলো তার মায়ের কোলে; তাই একজন নারী যদি একজন সফল মা ও প্রকৃত শিক্ষক হতে চান, তবে তাঁকে একইসঙ্গে সচেতন, শিক্ষিত, ধৈর্যশীলা ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: পরিবার ও বিবাহবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুন তাঁর বক্তব্যে বলেন— “মাতৃত্ব একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা তৎক্ষণাৎ ফল দেয় না। যেমন তাঁতি ধৈর্যের সঙ্গে একেকটি সুতো জুড়ে নকশা তৈরি করেন, তেমনি একজন মা ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সন্তানের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব বুনে তোলেন।”

সফল মাতৃত্বের পাঁচটি ভিত্তি
১️. শারীরিক সুস্থতা: মাতৃত্ব একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব; তাই শারীরিক শক্তি ও সজীবতা অপরিহার্য। একজন ক্লান্ত মা সহজেই রাগান্বিত হয়ে পড়তে পারেন, যা সন্তানের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২️. মানসিক ও আবেগিক ভারসাম্য: মায়ের মানসিক অস্থিরতা সন্তানের মনে সরাসরি ছাপ ফেলে। তাই নিজেকে শান্ত ও সুশৃঙ্খল রাখা মাতৃত্বের প্রথম শর্ত।
৩️. শিক্ষণ–দক্ষতা: একজন মা–শিক্ষিকা জানতে হবে সন্তানের প্রতিটি বয়সের চাহিদা, মানসিক বৈশিষ্ট্য ও শেখার ধরণ কী। সচেতন শিক্ষণ–পদ্ধতি ছাড়া ভালোবাসা ফলপ্রসূ হয় না।
৪️. সময় প্রদান: লালন–পালন কেবল উপস্থিতির বিষয় নয়; এটি “সচেতন উপস্থিতি”র দাবি রাখে। গল্প বলা, একসঙ্গে খাওয়া, খেলা করা—এই সময়গুলোই সন্তানের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে।
৫️. ধৈর্য ও ধারাবাহিকতা: লালন–পালন হলো এক দীর্ঘ বিনিয়োগ। আজ শেখানো আচরণ বা মূল্যবোধ হয়তো বছর পর ফল দেবে। তাই ধৈর্য ও ধারাবাহিকতাই একজন “অ্যাবার মাদার” বা “সুপার মা”–এর প্রকৃত শক্তি।

অংশ ১: তিন বছরের শিশুর জেদ ও পটি ট্রেনিংয়ের কার্যকর কৌশল
একজন মা প্রশ্ন করেন— “আমার তিন বছরের ছেলে খুব জেদি হয়ে গেছে এবং আমি এখন ডায়াপার বন্ধ করতে চাই। কীভাবে তা করব?”

শিশুর জেদের প্রকৃত উৎস: আত্মকেন্দ্রিকতা
সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুন ব্যাখ্যা করেন, দুই বছর পর শিশুর মধ্যে একটি প্রাকৃতিক বিকাশ ঘটে—যাকে মনোবিজ্ঞানে “আত্মকেন্দ্রিকতা (Egocentrism)” বলা হয়। এই সময় শিশুটি মনে করে সে-ই কেন্দ্র, সে-ই সব জানে। তাই যখন মা তাকে কোনো কিছু থেকে বিরত করেন, সে মনে করে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটিই জেদের সূচনা।

কার্যকর কৌশলসমূহ
১️. মনোযোগ স্থানান্তর পদ্ধতি: “না” বলার পরিবর্তে তার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিন—যেমন “চলো, এটা না করে ওটা দেখি।”
২️. ক্ষুদ্র দায়িত্ব দিন: শিশুকে ছোট কাজে যুক্ত করুন, যেমন নিজের খেলনা গুছানো বা টিস্যু এনে দেওয়া। এতে সে নিজেকে সক্ষম মনে করে।
৩️. ধৈর্য ও পুনরাবৃত্তি: একদিন বা এক সপ্তাহে ফল পাবেন না। প্রতিদিনের অনুশীলনই সাফল্যের পথ।

পটি ট্রেনিংয়ের আট ধাপ

১. ভাষাগত প্রস্তুতি: শিশুটি যেন বলতে পারে, “আমার পটি পেয়েছে।” এটি প্রথম সাফল্যের ধাপ।

২. গল্প বলা: ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাসকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করুন।

৩. চিত্র ব্যবহার: ধাপে ধাপে ছবি লাগান—বসা, পরিষ্কার করা, ফ্লাশ টানা, হাত ধোয়া ইত্যাদি।

৪. আচরণ পর্যবেক্ষণ: শিশু ভয় পেলে কিছুদিন বিরতি নিন; জোরাজুরি নয়।

৫. পরিবেশ তৈরি: ছোট টয়লেট সিট, পাদানি ও আরামদায়ক পরিবেশ দিন। প্রথম অভিজ্ঞতাটি যেন নিরাপদ হয়।

৬. সময় নির্বাচন: বাড়িতে শান্ত ও অবকাশপূর্ণ সময়ে প্রক্রিয়াটি শুরু করুন।

৭. ভুলে শাস্তি নয়: দুর্ঘটনা ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক। শিশুকে লজ্জা বা ভয় না দেখিয়ে সহানুভূতিশীল হোন।

৮. ধীরে পরিবর্তন: ডায়াপার বা বুকের দুধ হঠাৎ একসঙ্গে  বন্ধ করবেন না। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনুন।


অংশ ২: কৈশোরের ঝড়ো সময়ে অভিভাবকের ভূমিকা
কৈশোর হলো পরিবর্তনের সময়—আবেগ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও পরিচয়–বোধের সংঘাতের যুগ।

সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুন  বলেন— “এই সময়টিকে বলা যায় ‘ছাইয়ের নিচে আগুন’। বাইরে শান্ত, কিন্তু ভেতরে চলতে থাকে আবেগের তীব্রতা।”

সহনশীল শিক্ষণ: সহনশীলতা মানে শিথিলতা নয়; বরং ভালোবাসা ও শৃঙ্খলার ভারসাম্য।
উদাহরণ: যদি সন্তান ফুটবল ম্যাচ দেখতে চায় এবং আপনি চান সে বাজারে যাক, তখন বলুন— “তুমি ম্যাচটা দেখে নাও, তারপর একটু বাজারে যেও।” এতে দ্বন্দ্ব কমে, সহযোগিতা বাড়ে।

যোগাযোগ ও শ্রদ্ধা বজায় রাখা: কৈশোরে সন্তানকে শাসন নয়, বোঝাপড়া ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হয়।

যখনই আপনি ছাড় দেন, তাকে জানান: “আমি খবরটা পরে দেখব, তুমি আজকের খেলা দেখো।”
এভাবে সে শেখে—আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, সে-ও পরবর্তীতে আপনার কথা মানবে।

অংশ ৩: শিশুদের মোবাইল–আসক্তি ও প্রতিকার
দুই বছরের এক সন্তানের মা জিজ্ঞাসা করেন— “আমার সন্তান ফোন ছাড়া থাকতে পারে না। কী করব?”

সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুন বলেন, শিশু হলো আদর্শ অনুকারী। যদি সে দেখে বাবা–মা, ভাই–বোন সবাই ফোনে মগ্ন, সে-ও তাই করবে। অতএব প্রথম সংশোধন প্রয়োজন অভিভাবকদের আচরণে।

চারটি কার্যকর উপায়
১️. ফোনের নিষিদ্ধ এলাকা তৈরি করুন: খাবার টেবিল, পারিবারিক আড্ডা, শোবার ঘর—এই জায়গাগুলোতে ফোন নিষিদ্ধ রাখুন।
২️. নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন: শিশু ঘুমালে বা ব্যস্ত থাকলে ফোন ব্যবহার করুন।
৩️. ফোন চোখের আড়ালে রাখুন: বাড়িতে “ফোন রাখার বাক্স” রাখুন, যেখানে সবাই প্রবেশের আগে ফোন জমা রাখবে।
৪️. মানুষকে অগ্রাধিকার দিন: শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় ফোন বেজে উঠলে তা উপেক্ষা করুন।
এই আচরণ শিশুর মনে দৃঢ় করে—“আমিই মায়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

অংশ ৪: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানের পরিবর্তন ও পারিবারিক সংযোগ
আরেকজন অভিভাবক বলেন— “আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর আগের মতো ধর্মপরায়ণ নেই, পরিবারের সঙ্গে কম কথা বলে।”

সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুন  বলেন, পরিবেশ মানুষের চিন্তা ও আচরণ বদলে দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারার মিশ্রণ থাকে। যদি পরিবার সংযোগ হারায়, সন্তানের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে।

চারটি করণীয় পদক্ষেপ
১️. সুস্পষ্ট ও ভালোবাসাপূর্ণ প্রত্যাশা প্রকাশ করুন: “আমরা তোমার নামাজের নিয়মিততা নিয়ে গর্ব করতাম, আশা করি তা বজায় থাকবে।”
২️. নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন: ফোন, ভিডিও কল বা সরাসরি দেখা—যেকোনো উপায়ে সম্পর্ক সক্রিয় রাখুন।
৩️. সম্ভব হলে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি: বাড়ি থেকে দূরে পড়াশোনায় একাকিত্ব সৃষ্টি হয়; বুনিয়াদি পারিবারিক যোগাযোগ বজায় রাখলে মানসিক ভারসাম্য রক্ষা হয়।
৪️. অতীতের ভালো স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিন: “তুমি যখন সকালে নামাজে উঠতে, বাড়িটা আলোয় ভরে যেত।”
এই ইতিবাচক স্মৃতি সন্তানের অন্তরে নরম প্রভাব ফেলে।

একজন সফল মা ও আদর্শ শিক্ষিকা হলেন সেই নারী— যিনি নিজের শরীর, মন, সময় ও প্রজ্ঞা দিয়ে সন্তানের আত্মাকে গড়ে তোলেন। তিনি সন্তানের জীবনে নিয়ন্ত্রক নয়, পথনির্দেশক।

হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আলিরেজা তারাশিয়ুনের কথায়— “যে মা নিজেকে গড়ে তোলে, সেই মা-ই তার সন্তানকে গড়তে পারে। ধৈর্য, জ্ঞান ও ভালোবাসার সমন্বয়েই গড়ে ওঠে প্রকৃত ‘অ্যাবার মাদার’—যিনি পরিবার ও সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha